সাংস্কৃতিক জীবনের পাশাপাশি শাসকপদেও দক্ষ প্রশাসক হিসেবে বাংলার বাইরে রাজধর্ম পালন করে এসেছেন বহু বাঙালি। ইতিহাসের পাতায় এরকম কিছু ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় বাঙালির কথা আজ আলোচনা করবো। বরেন্দ্রভূমির তেড়া গ্রামে জন্মেছিলেন বাঙালি গদাধর। তিনি রাষ্ট্রকূট‍রাজ কৃষ্ণ (৯৩৯-৯৬৭ খ্রি: ) এবং খোট্টিগের অধীনে কার্তিকেয়-তপোবন নামে এক ভূখণ্ডের শাসক হয়েছিলেন। তাঁর রাজধানী ছিল ভারতের মাদ্রাজ প্রদেশের বেলারী জেলার কোলগল্লু গ্রাম। তিনি "গৌড়-চূড়ামণি", "ব‍রেন্দ্র-দ‍্যোতকারী" এবং "মুনি" ও "দুর্ভিক্ষ-মল্ল" উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন বলে এখানকার একটি প্রস্তর লিপিতে উল্লেখ রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য উপাধিটি হচ্ছে "দুর্ভিক্ষ-মল্ল, " যার অর্থ---"দুর্ভিক্ষ দমনকারী।" তাই তিনি যে দুর্ভিক্ষ দূর করে সফল শাসক হিসেবে পরিচিত হয়েছিলেন, তার প্রমাণ এই উপাধি। তিনি তাঁর রাজ‍্যে কুয়ো, পুকুর খনন করান এবং ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব-পার্বতী-কার্তিক-গণেশ ও সূর্য মূর্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

১১৯১ খ্রিস্টাব্দের আরেকটি লিপি থেকে জানা যাচ্ছে, গৌড় বংশোদ্ভূত রাজা অনেকমল্ল রাজত্ব করতেন গাঢ়োয়াল অঞ্চলে। তিনি কেদারভূমিসহ আশেপাশের এলাকা জয় করেন। বাঙালি লক্ষ্মীধরের পুত্র গদাধর ছিলেন চন্দেল্লরাজ পরমাদ্রীদেবের (১১৬৭-১২০২ খ্রি: ) সন্ধিবিগ্রহিক। আরেক বাঙালি লক্ষ্মীধর ছিলেন সাত পুরুষ ধরে চন্দেল্লরাজাদের রাজকর্মচারি। এর মধ্যে যশপাল, গোকুল ও জগন্ধর---এই তিনজন ছিলেন রাজমন্ত্রী। ১১০০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দেড়শো বছরেরও বেশি সময় এই বাঙালি পরিবার চন্দেল্লরাজাদের বিভিন্ন উচ্চ পদে বহাল ছিলেন।

পঞ্জাবের পার্বত্য এলাকায় অবস্থিত সুকেত, কেওস্থল, কাষ্টওয়ার ও মণ্ডী---এসব রাজ‍্যের রাজারা বাংলার গৌড় রাজবংশোদ্ভূত ছিলেন বলে প্রচলিত বিশ্বাস। এর মধ্যে কাষ্টওয়ার রাজ‍্যের প্রতিষ্ঠাতা কাহনপাল গৌড়ের রাজবংশোদ্ভূত ছিলেন বলে জনশ্রুতি। উল্লেখ্য, এই অঞ্চল দীর্ঘদিন পালরাজারা শাসন করতেন এবং তাই কাহনপাল পালবংশের লোক হতেও পারেন। আবার "হম্মীর কাব্য" গ্রন্থে চাহমানরাজ তৃতীয় পৃথ্বীরাজের এক বাঙালি বীর ছিলেন তাঁর অন্যতম সেনাপতি। পৃথ্বীরাজের হয়ে বহু যুদ্ধ করেছেন তিনি।

একবার মহম্মদ ঘোরী পৃথ্বীরাজের দিল্লি দখল করে নেন। সে সময় দিল্লি পুনরুদ্ধারের জন্য একমাস যুদ্ধ চালিয়ে যান বাঙালি বীর উদয়রাজ। ঘোরীর লোকজন এতে ভয় পেয়ে বন্দি পৃথ্বীরাজকে মুক্তি দিতে বলেন। কিন্তু ঘোরী তাঁদের কথা না শুনে পৃথ্বীরাজকে হত্যা করেন। পৃথ্বীরাজের মৃত্যু সংবাদ শোনার পরেও দিল্লি উদ্ধারের লক্ষ্যে বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যান এবং শেষে যুদ্ধক্ষেত্রেই শহীদ হোন। এভাবেই ইতিহাসের পাতায় ঠাঁই পেয়েছে বহু বাঙালি বীরের বীর-গাঁথা।